বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৬ অপরাহ্ন
ভাসানচরে পুরোদমে নতুন সংসার শুরু করেছে স্থানান্তরিত হওয়া রোহিঙ্গারা। হেসে খেলে বেড়াচ্ছে তাদের শিশুরা। নারীরা পরিবারের জন্য শুরু করেছে রান্না। পুরুষরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন আশপাশে, আলাপ-আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে। উন্নত পরিবেশ ও জীবনমানে খুশি এসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ইতিমধ্যেই তাদের আত্মীয় স্বজনদের ডাকতে শুরু করেছে ভাসানচরে। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হলেও দুই-এক মাসের মধ্যে আরও ৫ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামছু-দ্দৌহা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আরও রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা আমরা করছি। যারা সেখানে যাওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানাচ্ছেন আমরা তাদের তালিকা তৈরি করছি। সেই তালিকা অনুসারে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাসানচরে স্থানান্তরিত হওয়া কবির মিয়ানমারে ছিলেন শিক্ষক, কক্সবাজারে চাকরি করছেন একটি বিদেশি সংস্থার হয়ে। সেই চাকরি ছেড়ে গিয়েছেন ভাসানচরে। শুক্রবার নৌবাহিনীর জাহাজে করে ভাসানচরে যাওয়ার সময় কবির জানিয়েছিলেন, নিজের ছেলে মেয়েকে ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে ভাসানচরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গতকাল টেলিফোনে কথা হয় কবিরের সঙ্গে। ভাসানচর থেকে কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কক্সবাজার থেকে সবাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। দিনে ১০০ মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, ভিডিও দেখাচ্ছি। আমি বলেছি, যা ভেবে ভাসানচর আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানকার পরিবেশ তার চেয়েও ভালো। কবির বলেন, সবাই জানতে চায়, ভাসানচরে তারা কীভাবে আসতে পারবে। আমি সবাইকে স্যারদের (কক্সবাজারের আরআরসির কর্মকর্তারা) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। আমি নিজে আমার দুই ভাইয়ের পরিবারের ১৪ জনের জন্য স্যারদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন। পরবর্তী ব্যাচ ঠিক হলে জানাবেন।
চার দিন ভাসানচরে থাকা ওয়ালিউল্লাহও টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমি আমার সাত ছেলে মেয়ে নিয়ে ভাসানচরে এসেছি। তখন বাবা-মা ও ভাই বোনদের পরিবারকেও বলেছিলাম আসার জন্য। কিন্তু তারা আসতে রাজি হয়নি। এখন ভিডিও কলে আমার ঘর, রান্নাঘর, আলাদা বাথরুম টয়লেট দেখে তারা আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমি আমার বাবা-মা, ভাই-বোনের পরিবারসহ ৪২ জনকে আনতে চাই। ভাসানচরে সরেজমিন কবির-ওয়ালিউল্লাহর মতো মনোভাব দেখা গেছে অন্য রোহিঙ্গাদের মাঝেও।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভাসানচরে স্থানান্তরিত হওয়া রোহিঙ্গারাই আমাদের অ্যাম্বাসেডর হয়ে কাজ করবেন। তারাই অন্যদের প্রভাবিত করবেন ভাসানচরে আসার ব্যাপারে। মোবাইল ফোনে তাদের সঙ্গে অন্যদের যোগাযোগ হবে। ভাসানচরের রোহিঙ্গারা প্রত্যেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পাবেন। দুটি সিম ব্যবহার করে তারা ইন্টারনেট ও ফোনে কথা বলতে পারবেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এক সময়ের প্রত্যন্ত চরকে আমূল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যেখানে কিছু গাছ আর কয়েকটি মহিষ ছাড়া ছিল না, সেই চরকে এখন চোখ ধাঁধাঁনো আর্কিটেকচারাল প্ল্যানে নতুন রূপ দিয়েছে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী। প্রায় ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে নেওয়া এই প্রকল্পের সব কাজই শেষ। এখন যে কোনো সময় এখানে ১ লাখ ১ হাজার ৬০ জন গিয়ে বসবাস করতে পারবে। এক রুমে চারজনের থাকার জন্য দ্বিতল বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন ১৬টি রুম, নারী-পুরুষের জন্য আলাদা বাথরুম, টয়লেট ও রান্নাঘর নিয়ে বানানো হয়েছে একেকটি বাড়ি। এমন ১২টি করে বাড়ি নিয়ে একেকটি পাড়া বানানো হচ্ছে। পাড়াগুলোকে বলা হচ্ছে ক্লাস্টার। বিশাল এই প্রকল্পে এমন ১২০টি ক্লাস্টার বানানো হয়েছে। প্রত্যেক ক্লাস্টারে দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য বানানো হয়েছে চারতলার একটি করে শেল্টার। প্রাথমিকভাবে শেল্টার ভবন হিসেবে তৈরি হলেও ২০টি চারতলা ভবনকে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন কাজে। এর মধ্যে দুটি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে ২টি ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে সব ধরনের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা থাকছে এসব হাসপাতালে। এর বাইরে আরও চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে চারটি চারতলা ভবনে। একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের অফিস ও বাসস্থান হিসেবে। আলাদা ভবন থাকছে রেডক্রস বা রেডক্রিসেন্ট প্রতিনিধিদের জন্য। আরেকটি চারতলা ভবনে অফিস ও বাসস্থান থাকছে আরআরসি ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের। থাকছে একটি ভবনজুড়ে মাল্টি পারপাস সুপার শপ। পুলিশের একটি পূর্ণাঙ্গ থানা ও একটি ফাঁড়ি থাকছে দুই ভবনে। থাকছে দুটি চারতলা স্কুল ভবন। তিনটি চারতলা মসজিদও থাকছে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের জন্য। তৈরি হয়েছে দুটি এতিমখানাও। ডে- কেয়ার সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্যও রয়েছে আলাদা ভবন। গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের জন্য তৈরি হয়েছে নান্দনিক একটি গেস্ট হাউস। এ ছাড়া নেভির অফিসার ও নাবিকদের জন্য ব্যবস্থা হচ্ছে দুই নিরাপত্তা ভবন। প্রকল্প এলাকার ভিতরে যাতায়াতের জন্য বানানো হয়েছে ৪২ কিলোমিটার পাকা ও হেরিং বোম রাস্তা। আছে দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হেলিপ্যাড।
আগ্রহ বাড়ছে বিদেশি এনজিগুলোরও : ভাসানচরে স্থানান্তরিত হওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশের যে ২২টি এনজিও কাজ করছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বিদেশি দাতারা। এনজিও অ্যালায়েন্স অব ভাসানচরের সমন্বয়ক ও পালস বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম জানান, আমরা এখনো নিজেদের প্রস্তুতিতেই কাজ করছি। নিজস্ব তহবিলেই আমরা এক বছরের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় নিশ্চিত করছি। কিন্তু আমাদের দাতা সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তারা ভাসানচরে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
Leave a Reply