বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫১ অপরাহ্ন
কক্সবাজার পুলিশের বড় রদবদল বিষয়টি এখন টক অফদ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে জেলা পর্যায়ে একসাথে এতবড় গণবদলী এবং নিয়োগের বিষয়টি ইতোমধ্যে জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমেও গুরুত্ব পাচ্ছে। একই সাথে কক্সবাজারে পুলিশে কি হতে যাচ্ছে এমন প্রশ্ন করছিল জেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজন। এদিকে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে সিপাহী পর্যন্ত বদলীর বিষয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষজন অনেকটা হতবাক, আবার অনেকে এই বদলীকে সাধুবাদ জানিয়ে আগামিতে দায়িত্বপালনে আসা পুলিশ সদস্যদের জনগনের আস্থা অর্জন করে পুলিশ জনগন দুরত্ব দুর করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর ওয়েবসাইট সুত্রে জানা গেছে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত কক্সবাজারের ১৩৪৭ জন পুলিশ সদস্যকে একযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় বদলী করা হয়েছে। একইসাথে ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার জনকে দ্রুত কক্সবাজারে যোগদান করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ে পুলিশের এতবড় রদবদলের কারণ জানতে চেয়ে গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে একই সাথে স্থানীয় মানুষজন বিষয়টি নিয়ে দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। আলাপকালে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এপিপি এড. তাপস রক্ষিত বলেন, জেলা পর্যায়ে পুলিশের এতবড় বদলি আর দেখিনি। আমার মতে ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে মেজর (অবঃ) সিনহা হত্যার পরে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আটকের পর যেসব ঘটনা সামনে আসছে সেটা কখনো কাম্য নয়। আমরা দেখেছি টাকার জন্য বন্দুকযুদ্ধের নামে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, টাকার জন্য নিরীহ মানুষকে মাদক মামলায় আসামী করা হয়েছে। এটা একটি স্বাধীন দেশে কোনভাবেই কাম্য নয়। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। সেজন্য হয়তো সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মনে করেছে নতুন এবং ক্লিন ইমেজের পুলিশ দিয়ে কাজ করালে হয়তো তারা আবার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গণবদলীকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। টেকনাফ সুজন সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসের রাজু বলেন, টেকনাফ থানার জন্য এই গণবদলী আবশ্যকীয় ছিল,কারণ এখানে যারা বিতর্কিত ওসি প্রদীপের সাথে কাজ করেছে তারা প্রত্যেকে কোন না কোন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল, শুধু অফিসার পর্যায়ে নয় টেকনাফ থানার সিপাহী পর্যন্ত টেকনাফের মানুষকে কুকুরের মত আচরণ করেছে। তারা যে সরকারি চাকরি করতে এসেছে সেটা ভুলে গিয়ে অনেকে মানুষের কাছে মুর্তিমান আতংকে পরিনত হয়েছিল। তাই আমরা মনে করি এই গণবদলী টেকনাফের মানুষকে স্বস্হি দিয়েছে। এখন যারা নতুন দায়িত্ব পালন করতে আসবে তাদের কাছে আহবান থাকবে পুলিশ বলতে এখানকার মানুষের মনে যে ভীতি তৈরি হয়েছে সেটা দুর করতে হবে। একই সাথে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে কোনভাবে ছাড় না পায় সেদিকে কঠোর নজরদারী রাখতে হবে। এদিকে উখিয়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহামদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ইয়াবার ব্যাপক পাচার রোধে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে এটা যেমন সত্য একি সাথে কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য সমালোচিতও হয়েছে। তবে কয়েকজনের অপরাধের জন্য সব পুলিশকে দায়ী করা যায়না। তবুও পুলিশের আগামীদিনে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোন নিরীহ মানুষ মামলার আসামী না হয়, আর কোন অপরাধী যাতে ছাড় না পায়। কক্সবাজার জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড. জিয়া উদ্দিন আহামদ বলেন, জেলা পুলিশের এতবড় রদবদল সত্যি অবাক হওয়ার মত। তবে এটাও ঠিক অনেক পুলিশ সদস্য আছেন যারা ১২/১৫ বছর ধরে কক্সবাজারে আছে এতে তাদের মধ্যে একঘেয়েমী চলে এসেছিল। তাই এই পরিবর্তন সেদিক থেকে কল্যাণকর অপরদিকে কোন ভাবেই যেন পুলিশের মনোবল নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে আমরা চাই পুলিশ এবং জনগন বন্ধু হিসাবে আগে যে ঐতিহ্য ছিল সেটা ফিরে আসুক। এ ব্যপারে কক্সবাজার সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সভাপতি প্রফেসর এম এ বারী বলেন, বিশাল একটি বাহিনীর মধ্যে কয়েকজনের দোষত্রুটি থাকতে পারে। তাই বলে সব পুলিশকে মন্দ বলা যাবে না। তবুও সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। আমাদের প্রত্যাশা পুলিশ জনগন মিলে কক্সবাজার থেকে মাদক চীরতরে নির্মুল করবে এবং পুলিশ সত্যিকার অর্থে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করবে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, পুলিশের বদলী এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তবে এবার গণহারে হওয়াতে এটা বেশি আলোচনা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকে ঘুরে ফিরে জেলার বিভিন্ন থানাতে ১০/১২ বছর রয়ে গেছে ফলে তাদের সাথে বিভিন্ন মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন নতুন সেটাপ আসলে সেই ধারাবাহিকতা ভাংবে এতে মানুষের জন্য উপকার হবে। আর যারা নতুন আসছেন তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হবে তারা যেন প্রকৃত অর্থে মানুষের সেবা করেন এবং আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রনে রাখেন। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি সাবেক সংসদ অধ্যাপিকা এথিন রাখাইন বলেন, সরকার যা করে জনগনের ভালোর জন্যই করে। আমার মতে পুলিশের এই বড় বদলীতে নিশ্চই কক্সবাজারের মানুষের জন্য ভাল কিছু লুকিয়ে আছে।
কক্সবাজারের ৮ থানার নতুন ৮ ওসির যোগদান
দেশের ইতিহাসে জেলা পুলিশের এতবড় বদলির নজির নেই বলে জানিয়েছেন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৩৪ জন ইনস্পেক্টরকে বদলি করা হয়। এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারকে এবং ২১ সেপ্টেম্বর বদলি করা হয়েছিল আরও ৭ জন কর্মকর্তাকে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলার আট থানায় নতুন আট পুলিশ পরিদর্শককে ওসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেছেন বলে জানা গেছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক( ডিআইজি) এক আদেশে এই আট কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে পদায়ন করেন।
বহুল আলোচিত ও ইয়াবার জন্য ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া সীমান্ত থানা টেকনাফের ওসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশে কর্মরত মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানকে। এ ছাড়া, সাতক্ষীরার শেখ মুনিরউল গিয়াসকে কক্সবাজার সদর মডেল থানা, সুনামগঞ্জের আহম্মদ সনজুর মোরশেদকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া থানা, নওগাঁর মোহাম্মদ আবদুল হাইকে মহেশখালী থানা, গোপালগঞ্জের শাকের মুহাম্মদ জুবায়েরকে চকরিয়া থানা, নীলফামারীর কে এম আজমিরুজ্জামানকে রামু থানা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইফুর রহমান মজুমদারকে পেকুয়া থানা ও মৌলভীবাজারের মো. জালাল উদ্দীনকে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া থানার ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আদেশে তাদের ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামকে একই পদে কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রশাসন শাখায়, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মামুন আল ইসলামকে কক্সবাজার সদর সার্কেলে, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার পংকজ বড়ুয়াকে কক্সবাজার সদরে, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো. জাহেদুল ইসলামকে মহেশখালী সার্কেলে, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার কাজী শাহাবুদ্দীন আহমদকে কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগে, র্যাবের সহকারী পুলিশ সুপার মো. তফিকুল ইসলামকে চকরিয়া সার্কেলে ও খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম শাহনেওয়াজকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় পদায়ন করা হয়েছে।
ডিএমপিতে বদলি হওয়া কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘আমিসহ ছয় জন আজ শনিবার দায়িত্ব হস্তান্তর করব। বাকি অপরজন ট্রাফিক পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার কালকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবেন। আজ নবনিযুক্ত আট থানার ওসিরা নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেছেন।’
পুলিশ সদর দপ্তর ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশে নতুন ৪০ জন পরিদর্শক, ১০ জন ট্রাফিক পরিদর্শক, ১৮৯ জন উপপরিদর্শক, ৮ জন ট্রাফিক সার্জেন্ট, ৫ জন শহর উপপরিদর্শক, ১৬৯ জন সহকারী উপপরিদর্শক, ১৯জন শহর সহকারী উপপরিদর্শক, ৫০ জন নায়েক ও ১ হাজার ৭ জন কনস্টেবল পদায়ন করেছে।
Leave a Reply