বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
ডা. ইসমাইল আজহারি ।
মানব দেহে প্রতিনিয়ত অনেক বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়, যা মল ও মূত্রের মাধ্যমে শরির থেকে বেরিয়ে যায়, এবং শরির কে সুস্থ রাখে।শরিরের অধিকাংশ বর্জ্য পদার্থ মল ত্যাগের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, আর কিছু বর্জ্য পদার্থ যা শরীরে থাকা ক্ষতিকর, তা ইউরিন বা প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে শরীরকে সতেজ রাখে।
ইউরিন বা প্রস্রাব মূলত কিডনি নামক একটা ছাঁকনি যন্ত্র দিয়ে রক্তকে ছাঁকন করার মাধ্যমে তৈরি হয়, মানুষের দুইটা কিডনির মাধ্যমে প্রতি মিনিটে ১ লিটারের উপর রক্ত ছাঁকন হয়, এই রক্ত ছাঁকনের মাধ্যমে রক্তে উপস্থিত ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ যথা ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি শরির থেকে বেরিয়ে যায়।
যদি কোনো কারণে কিডনিতে ইনফেকশন হয় কিংবা কোনো কিডনি রোগ হয়, তাহলে রক্তে উপস্থিত ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক এসিড ইত্যাদি কিডনি দিয়ে ছাঁকন হতে পারেনা, এবং রক্তে এইসব কেমিক্যাল এর পরিমান বেড়ে যায়।
মূত্রতন্ত্র- মূলত কিডনি দিয়ে মূত্র তৈরি হলেও মূত্রতন্ত্র বলতে ৪ টা অংশকে বুঝায়, ১. কিডনি যেখানে প্রতি মিনিটে ১২০০ মিঃলিঃ রক্ত ছাঁকন হয়ে প্রতি মিনিটে ১-২ মিঃলিঃ ইউরিন তৈরি হয়.
২. ইউরেটার. এইটা কিডনি থেকে মূত্রথলি পর্যন্ত একটা সরু নালিকা, যার মাধ্যমে কিডনিতে তৈরি হওয়া ইউরিন মূত্রথলিতে গিয়ে জমা হয়.
৩.মূত্রথলি বা ব্লাডার- যেখানে মুত্র জমা হয়, ৪..ইউরেথ্রা বা মূত্রনালী- মূত্রথলি থেকে যেই পথ দিয়ে মূত্র ত্যাগ করা হয়।
এবার জেনে নিই, ইউরিন ইনফেকশন কাকে বলে? মূত্রতন্ত্রের ৪ টি অংশের যে কোনো অংশ যদি জীবানু দিয়ে সংক্রমণ হয়, তাহলে সেটাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউরিন ইনফেকশন বলা হয়, এবং অনেকে এইটাকে প্রস্রাবের ইনফেকশন ও বলে থাকে। ইউরিন ইনফেকশন নারী পুরুষ উভয়ের হতে পারে, তবে নারীদের সংক্রমণের হার বেশি।কারণ তাদের মূত্রনালি পায়ুপথের খুব কাছাকাছি থাকায় সেখানে মল ত্যাগের সময় জীবানু প্রবেশ করে ইনফেকশন করার প্রবণতা বেশি।
ইউরিন ইনফেকশন এর উপসর্গ-১.প্রসাবের সময় মূথনালিতে জ্বালাপোড়া করা কিংবা ব্যাথা করা। ২. গায়ে গায়ে জ্বর থাকা, কিংবা কাপুনি দিয়ে জ্বর আসা, কিডনিতে ইনফেকশন হলে কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে, আর মূত্রতন্ত্রের অন্যান্য অংশে ইনফেকশন হলে জ্বর আসলেও সাধারণত কাপুনি দিয়ে জ্বর আসেনা, অনেক মহিলা বলে থাকেন, তাদের দীর্ঘ দিন থেকে থেকে গায়ে গায়ে জ্বর, প্রস্রাবে মাঝেমধ্যে জ্বালাপোড়া করে, এইসব ক্ষেত্রে প্রস্রাব পরিক্ষা করলে দেখা যায়, তাদের প্রস্রাবে ইনফেকশন রয়েছে।
৩. তলপেটে ব্যাথা করা কিংবা প্রস্রাবের সময় ব্যাথা হওয়া ৪. প্রস্রাবের রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। ৫.কিছুক্ষণ পরপর প্রস্রাবের বেগ হওয়া, এবং প্রস্রাব করার পর মনে হওয়া যে আবার প্রস্রাব হবে। ৬. বমি বমি ভাব হওয়া বা বমি করা, এবং খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া, শরীর দূর্বল লাগা।
৭। প্রস্রাবে দুর্গন্ধ লাগা কারণ- ইউরিন ইনফেকশনের অনেক কারণ রয়েছে. তবে মূল কারণ হচ্ছে মূত্রপথে ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ তা কয়েক ভাবে হতে পারে.
১. মলত্যাগের সময় পায়ুপথ থেকে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে ডুকে যাওয়া.
২. মলত্যাগের পর পায়ু পথে পিছন থেকে সামনের দিকে টয়লেট টিস্যু ব্যাবহার করলে টিস্যু মূত্রপথের সংস্পর্শে এসে ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ইনফেকশন করতে পারে।
৩. যৌনমিলনের সময় ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে, এইটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলেনা।
৪. যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য লেগে থাকে, বিশেষ করে বাচ্ছাদের কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে ইউরিন ইনফেকশন এর ঝুঁকি বেড়ে যায়,
৫। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যথা যাদের ডায়াবেটিস বা ক্যান্সার রয়েছে, অথবা যারা ক্যানসার এর ঔষধ পাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশন এর ঝুঁকি বেশি।
৬। যারা হাই কমোড ব্যবহার করে, কারণ কমোডে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া যে কোনো উপায়ে মূত্রনালীতে চলে এসে ইনফেকশন করতে পারে।
৭। যারা অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার ওভার গ্রোথ হয়ে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে।
৮। যারা পানি কম পান করে, তাদের ইউরিন আউট ফুট কম, তাই ব্যাকটেরিয়া জমে গিয়ে ইনফেকশন হতে পারে।
৯। ক্যাথেটার লাগালে সেইক্ষেত্রেও ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে, তা ছাড়া যাদের মূত্রপথে কোনো পাথর কিংবা যাদের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় তাদের ইউরিন ইনফেকশনের ঝুকি বেশি।
১০। টাইট জামা কাপড় পরিধান করলে ঘামিয়ে ব্যাক্টিরিয়ার পরিমান বৃদ্ধি পেতে পারে, যারা নিয়মিত গোসল করেনা, কিংবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকেনা, তাদের ও ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ইনফেকশন হতে পারে।
১১। গর্ভবতী অবস্থায় ইনফেকশন এর পরিমান বাড়তে পারে
১২। মাসিকের রাস্তায় সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে না পারলে কিংবা মাসিকের বর্জ্য মূত্রপথের সংস্পর্শে এসে সেখানে ইনফেকশন তৈরি করতে পারে
প্রতিরোধ-
১.মল ত্যাগের পর টিস্যু ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা, অবশ্যই টিস্যু দিয়ে মোছার সময় সামনে থেকে পিছনে মুছবে, পানি ব্যবহার এর সময়েও একই নিয়ম অনুসরণ করবে, এতে করে ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ রোধ করা যাবে
২. বেশি বেশি পানি পান করবে, দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পান করবে। বেশি পানি পান করলে বেশি বেশি প্রস্রাব হবে, এবং প্রস্রাবের সাথে জীবানু শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে, ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে যাবে।
৩। কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক কমে যায় ৪। যাদের বারবার ইনফেকশন হয়, তারা পুকুরের পানিতে গোসল করা থেকে বিরত থাকবে।
৫।বেশিক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে না রাখা। প্রস্রাবের ধরার সাথে সাথে প্রস্রাব করে নিবে। কারণ অনেক্ক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখলে মূত্রথলিতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমান অনেক বেড়ে যায়, যা থেকে ইনফেকশন হতে পারে।
৬। সেক্সের আগে ও পরে প্রস্রাব করে নেওয়া এবং ভ্যাজাইনার আশপাশ ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া। ৭। পাতলা ঢিলেঢালা সুতির কাপড় পরা, টাইট জামা পরলে ভ্যাজাইনা, ইউরেথ্রার আশেপাশে বেশি বেশি ঘামাতে পারে, এবং অতিরিক্ত ঘামে শরিরের ব্যাক্টিরিয়ার সংক্রমণ হয়।
৮। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, নিয়মিত গোসল করা, এবং মাসিকের সময় সঠিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা।
৯। যাদের বার বার ইনফেকশন হয়, তারা প্রতিরোধ মূলক ২-৩ মাস ডাক্তারের পরামর্শক্রমে এন্টিবায়োটিক খাওয়া।
১০। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা,
১১। প্রচুর ভিটামিন এ, ই, সি সমৃদ্ধ খাওয়ার খাওয়া, যথা টক ফল, আমড়া পেয়ারা, শষা ইত্যাদি খাওয়া, এবং প্রচুর শাকসবজি খাওয়া।
চিকিৎসা- যেহেতু ইউরিনারি ইনফেকশন একটা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ জনিত রোগ, তাই এই রোগ হলে দ্রুত ডাক্তার এর শরানপন্ন হয়ে চিকিৎসা করা দরকার, চিকিৎসা অবহেলা করলে কিডনি ইনফেকশন হয়ে কিডনি ড্যামেজ হতে পারে। পরীক্ষা নিরিক্ষা করে যথা ইউরিন মাইক্রোসকোপিক ও ইউরিন কালচার সেনসিটিভিটি করে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা আবশ্যক। বারবার ইনফেকশন হলে দীর্ঘমেয়াদি এন্টিবায়োটিক লাগতে পারে।
লেখক: সিইও- সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স এন্ড রিসার্চ।
Leave a Reply