মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান।।
শবে কদর এমন এক মহিমান্বিত রাত, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। এজন্য পুরো মাসব্যাপী এই রাতকে সন্ধান করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে রমযান মাসে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে বলা হয়েছে। শবে কদরের সওয়াব পাওয়ার জন্য কোনো প্রকার নূর বা অন্য কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করা আবশ্যক নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রমযানের প্রতি রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত এবং প্রত্যেক রাতকে মনে করা উচিত যে, এটাই শবে কদর।
শবে কদর বাক্যটির বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, শব অর্থ হচ্ছে রাত। আর কদর শব্দটির দুটি অর্থ—এক, পরিমাণ ও পরিমাপ, এখান থেকেই তাকদির শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। দুই, সম্মান ও মহিমা। আরবি ভাষায় শব্দটি উভয় অর্থেই ব্যবহার হয়। কুরআনে এই দুই অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। তবে কেউ কেউ ‘কদর’ শব্দটিকে সংকীর্ণ অর্থেও ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, যেহেতু এই রাতে সারা বিশ্বে ফেরেশতাদের সমাগম থাকে, তাদের আবির্ভাবের কারণে আসমান ও জমিনের জায়গা ভর্তি হয়ে যায়, অপরের জন্য আর কোনো স্থান থাকে না। তাই শব্দটিকে ‘সংকীর্ণ’ অর্থেও ব্যাখ্যা করা যায়।
হাজার মাসের চেয়ে উত্তম যে রাত
শবে কদর হাজার মাস থেকেও উত্তম। হাজার মাসে ৮৩ বছর চার মাস হয়। শবে কদরকে হাজার মাসের সমান সমান বলা হয়নি; বরং হাজার মাস থেকে উত্তম বলা হয়েছে। হাজার মাস থেকে শবে কদর কী পরিমাণ উত্তম, তা আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। তবে এই রাত মুমিন বান্দার জন্য অনেক বড় নিয়ামতের বিষয়। এক রাত জেগে ইবাদত করলে হাজার মাস থেকেও বেশি ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়।
পূর্বের উম্মতের লোকদের বয়স অনেক বেশি হত। এই উম্মতের লোকদের বয়স অনেক কম। গড়পরতা হিসেব করলে ৭০ বা ৮০ এর মধ্যেই আমাদের গড় আয়ু। আল্লাহ এই উম্মতকে ইহসান করে এমন এক রাত দান করেছেন, যে রাতের আমাল হাজার বছরের ইবাদতের চেয়েও বেশি। সময় ও মেহনত কম, কিন্তু সওয়াব বেশি। এই উম্মতের ওপর এটাই আল্লাহ পাকের পুরুস্কার।
শবে কদর কত তারিখে?
বুখারি শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নের মাধ্যমে শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখের সন্ধান দেয়া হয়েছিল। তিনি উম্মতকে এই সুসংবাদ দেওয়ার জন্যই আসতে ছিলেন। এমতাবস্থায় রাস্তায় দুজন লোককে বিতর্ক করতে দেখলেন, যার ফলে সেই নির্দিষ্ট রাতটির কথা ভুলে গেলেন।
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, এই দুইজন লোক হচ্ছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হাদরাদ এবং কাআব ইবনে মালিক রা.। তারা কোনো একটা বিষয় নিয়ে তর্ক করছিল, ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সে রাতের নির্দিষ্ট তারিখকে চিরতরে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
এটি এমন এক বিস্মৃতি, যা কিয়ামত পর্যন্ত আর স্মরণে আসবে না। তবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বছরের বিভিন্ন তারিখের দিবাগত রাতে বা মাসের বিভিন্ন রাতে এই শবে কদর অনুসন্ধান করেছেন এবং উম্মতকে অনুসন্ধান করতে নির্দেশ করেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, শিয়া সম্প্রদায়ের কতকেরা বলে থাকে যে, শবে কদর চিরতরে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের এসব কথা সঠিক নয়।
তবে একথা সত্য যে, শবে কদর সম্পর্কে আজও কোনো চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. এর মতে শবে কদর নির্ধারণের ব্যাপারে চল্লিশের অধিক মতামত রয়েছে। তবে এসব মতামত থেকে সারকথা দুইভাবে বিভক্ত করা যায়—এক, শবে কদর শুধু রমযান মাসেই সীমাবদ্ধ। দুই, শবে কদর সারা বছরের যে কোনো রাত হতে পারে।
যারা শবে কদরকে স্রেফ রমযান মাসেই সীমাবদ্ধ মনে করেন, তাদের কারোর মতামত হলো, শবে কদর শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর যে কোনো একটিতে সংঘটিত হয়।
এদের মধ্যে আবার অন্যরা বলেন, প্রত্যেক বছর বিজোড় ৫ রাতের মধ্যে যে কোনো একটি নির্দিষ্ট রাতে সংঘটিত হবে। যেমন, ২৫ তারিখে শবে কদর হলে প্রত্যেক বছর ২৫ তারিখেই নির্দিষ্ট হবে।
কেউ কেউ এই মত প্রত্যাখ্যান করে বলেন, প্রতি বছর একই তারিখে শবে কদর হওয়ার মতটি সঠিক নয়; বরং এক বছর ২৫ হলে পরের বছর ২১, ২৩, ২৭, ২৯ তারিখও হতে পারে।
তবে অনেক উলামায়ে কেরামের মত হলো, শুধু রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতেই শবে কদর হবে, বিষয়টি এমন নয়। পুরো রমযান মাসের যে কোনো রাতেই শবে কদর হতে পারে। যেমন, আবু দাউদ শরিফে এসেছে, হযরত ওমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শবে কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, এটি সমস্ত রমযানেই রয়েছে। তাদের মতে, রমযানের ১, ১৭ অথবা ১৯ তারিখে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
যারা বলেন, শবে কদর স্রেফ রমযান মাসেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের নিকট সারা বছরের যে কোনো মাসের যে কোনো রাতেই শবে কদর হতে পারে। এই মতের পক্ষে আছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং অধিকাংশ কুফাবাসীর উলামায়ে কেরাম। তবে আল্লামা মুহাক্কিক ইবনে হুমাম রহ. বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে শবে কদর অন্য মাস অপেক্ষা রমযান মাসেই সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
শবে কদর অনির্দিষ্ট থাকার রহস্য
আল্লাহ পাক নিজেই এই মহিমান্বিত শবে কদরের এক মুহূর্ত ইবাদতকে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে অধিক পূণ্যময় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে করে মানুষ শবে কদর পাওয়ার জন্য অদম্য বাসনায় নিমগ্ন থাকবে এবং অধিক মাত্রায় ইবাদত ও রিয়াযত করে নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করবে। এরপর বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অফুরন্ত নিয়ামতসমূহ লাভে ধন্য হবে।
এখন যদি এই শবে কদরকে গোপন বা অনির্দিষ্ট না করে নির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ করে দেয়া হত, তাহলে এই রাতের গুরুত্ব কমে যেত এবং মানুষও সমস্ত ইবাদত ও রিয়াযত ছেড়ে দিয়ে স্রেফ শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখে ইবাদতের ওপর নির্ভর করে বসত। মুস্তাদরাকে হাকিম-এর ভেতর একটি হাদিস আছে, যাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রহস্যটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
শবে কদরের কিছু আলামত
হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, এরপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে শেষ দশকে। সে রাত হবে সাদা-উজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণ হবে—না গরম, না ঠাণ্ডা, যেন আলোকিত চাঁদ নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে, ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতে শয়তান বের হতে পারে না।
এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, যদিও শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখ ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তবুও আমরা যাতে শবে কদর পেতে পারি, সে জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু আলামত বলে দিয়েছেন। এই সম্পর্কে একটি হাদিসে আছে, হযরত কাআবকে ইবনে হুবাইস জিগ্যেস করলেন, আপনি শবে কদরের রাতটিকে কীভাবে অনুধাবন করেন? তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কিছু আলামত বলে দিয়েছেন, আমরা তার মাধ্যমেই শবে কদরকে অনুধাবন করি। এরপর তিনি একটি আলামত বললেন যে, শবে কদরের দিন সূর্যের তাপ ম্রিয়মান হবে। কারণ, লাইলাতুল কদরের রাতে অধিক সংখ্যক ফেরেশতার আগমন ও প্রত্যাবর্তনের কারণে সূর্য তাদের পাখার আড়ালে থেকে যায়, এ কারণে সূর্যের তেমন কিরণ, তাপ থাকে না।
এছাড়াও আরো কিছু আলামত বিভিন্ন কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। যেমন, সেই রাতের কুরআন তেলাওয়াত অন্য রাতের তুলনায় অধিক তৃপ্তিদায়ক হবে। সেই রাতের ইবাদত ও রিয়াযত অন্য রাতের তুলনায় অধিক একাগ্রতার সাথে হবে। ইবনে হাজার আসকালানির মতে, সেই রাতে সমস্ত মাখলুক আল্লাহ পাকের সিজদারত থাকবে। প্রত্যেক স্থানে নূরের জ্যোতি চমকাতে থাকবে, অন্ধকারের মধ্যেও নূরের জ্যোতি বিদ্যমান থাকবে। সেই রাতে ফেরেশতাদের সালাম ও কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যাবে। সেই রাতের শেষ ভাগে হালকা বৃষ্টি হয়ে থাকবে।
শবে কদরের আমল
রমযাস মাস যেমন আমাদের আত্মশুদ্ধির জন্য একটি মোবারক মাস, তেমনি শবে কদরও সওয়াব অর্জনের একটি পূণ্যময় রাত। বান্দার উচিত, এই রাতের বরকত হতে সৌভাগ্যশীল হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ব্রতী হওয়া। বস্তুত কোনো কাজই বিয়াযত বা সাধনা ছাড়া হাসিল হয় না। তাই এই রাতের বরকত লাভ করতে হলে কিছু ত্যাগ ও কুরবানি স্বীকার করতে হবে, অর্থাৎ আমল করতে হবে। যেমন, বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা। কারণ, এই রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছিল। বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা। অধিক পরিমাণে যিকির আযকার করা। বেশি বেশি নফল নামায পড়া। বিশেষ করে সালাতুত তাসবিহ আদায় করা। এ রাতে তাহাজ্জুদও পড়তে পারবে। গোটা রমযান মাসে সাহরির সময় একটু হিম্মত করলেই তাহাজ্জুদের কদর করা যায়।
তবে মনে রাখতে হবে, শবে কদরের কোনো নির্দিষ্ট নামায বা নামাযে নির্দিষ্ট কোনো সূরার বিধান নেই। যেভাবে অন্যান্য সকল নামাযের হুকুম, অনুরূপ এ রাতের নামাযেও একই হুকুম।
শবে কদরের দোয়া
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যদি আমি জানতে পারি অমুক রাত শবে কদর, তখন আমি কী দোয়া পড়বো? তিনি বললেন, এই দোয়া পড়বে—(উচ্চারণ) আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুববুন তুহিব্বুবল আফওয়া ফা’ফু আন্নী। এটি ছাড়াও অন্যান্য দোয়া পড়া যায়।
আল্লাহ পাক আমাদের পরিপূর্ণভাবে শবে কদরকে অনুসন্ধান করার তওফিক দান করুন। এবং শবে কদরকে পাইয়ে দিয়ে আমাদেরকে সৌভাগ্যশীল বান্দাদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে পারেন মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিজাহুল্লাহ রচিত ‘রমযানের হাদিয়া’ এবং ‘মাসায়েলে রমযান ও ঈদুল ফিতর’ গ্রন্থ দুটি। বই দুটি পাওয়া যাবে যাত্রাবাড়ি মাদরাসা সংলগ্ন কিতাব মার্কেটে এবং বাংলাবাজারের মাকতাবাতুল আবরারে।