শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩ পূর্বাহ্ন

সু চির বিজয় ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী

সু চির বিজয় ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি বিগত ৮ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বিরাট জয়লাভ করেছে। এই দল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ৩৯৬টি সংসদীয় সিট পেয়েছে, ৮৬ শতাংশ আসনই এমন। দেখা যাচ্ছে, এই বিজয় এনএলডির বিগত ২০১৫ সালের বিজয়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছে, সংখ্যার দিক দিয়ে। সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১৯৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এনএলডি পর্যায়ক্রমে জনগণের সমর্থন পায় শুধু অং সান সু চির কৌশল ও জনপ্রিয়তার কারণে। এনএলডি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে এবার ৩৯৬টি আসন পেয়েছে, যা গতবার ছিল ৩৯০, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিট হওয়ায় সরকার গঠনের জন্য আসনগুলো খুবই মূল্যবান। সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বিরোধী পক্ষে সবচেয়ে বড় জোট ও শক্তি, পেয়েছে মাত্র ৩৩ সিট, ২০১৫ সালের চেয়ে ৮টি কম, আর সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক দল পেয়েছে ৪৭ আসন।

গত নির্বাচনে সু চি যেসব ওয়াদা করেছিলেন সেগুলো রাখতে না পারলেও ভোটাররা এনএলডিকে ভোট দিয়েছেন। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে শান্তি স্থাপন, উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং সংবিধান ‘রিভাইজ’ করার কাজ সু চি করতে পারেননি। দেশব্যাপী বিভিন্ন ইস্যুতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী সু চির গতিপথ রোধ করলেও জনগণ তাকে সমর্থন দিয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সু চিকে পুনঃ ক্ষমতায়ন করায় তার দায়িত্ব বেড়ে গেছে; অন্তত তিনটি বড় ইস্যুতে তাকে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। প্রথম হলো সংবিধান পরিবর্তন করা। সংবিধানে এক-চতুর্থাংশ সংসদীয় সিট সেনাবাহিনীর জন্য রাখা আছে। সে হিসেবে বর্মী সংবিধান দুনিয়ার এক আজব সংবিধান। এর পরিবর্তনে তিন-চতুর্থাংশ ভোট ছাড়াও সেনাবাহিনী নিয়োজিত অন্তত একজন আইনজ্ঞের ভোট বা সম্মতি প্রয়োজন। নতুবা কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।

সুচি কোনো কৌশলে সফলকাম হলেও দেশে সামরিক ক্যু ঘটলে গণতন্ত্র অন্ধকার কূপে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। তার দ্বিতীয় কাজ: বিদ্রোহী দলগুলোর সাথে শান্তি আলোচনা। মিয়ানমারে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর অন্তত ২০টি গোষ্ঠী অস্ত্র হাতে সরকারের বিরুদ্ধে নামে। সু চি ফেডারেল ধরনের সিস্টেম গঠন করে, সবার অধিকার সংরক্ষণ করে, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চিন্তা করেছিলেন এবং তার বাবাকে যারা মাত্র ৩২ বছর বয়সে হত্যা করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো প্রতিশোধ নেয়ার প্রচেষ্টা চালাননি।

ফেডারেল প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক দলগুলো স্বায়ত্তশাসনের আশায় তাদের সশস্ত্রবাহিনীকে রেখে দিতে চায়। কিন্তু সেনাবাহিনী এ ধরনের সব সশস্ত্র দলকে দেশের বর্ডার গার্ডের সাথে সংযুক্ত করতে চায়। আর তৃতীয় বিষয়টি হলো ধর্মীয় সঙ্ঘাত। ২০১৭ সালে ৭ লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গার ওপর নির্যাতন শুরু করে তাদের উদ্বাস্তু করা হয়। ২০১৯ সালে সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এমন করেনি বলে জানান। কিন্তু এর আগেই সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বহু অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে। আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে সু চি, ‘incomplete and misleading factual picture of the situation.’ বলে অভিহিত করেন। মিডিয়া, সরকার ও এনজিও সু চি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ। যারা এতদিন তার পক্ষে ছিলেন তারাও বিপক্ষে চলে যান।

নির্বাচনের সময় মুসলিম বিদ্বেষী ও স্বল্পশিক্ষিত সন্ন্যাসী অশ্বিন বিরাথু সব বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডেকে এনএলডির বিপক্ষে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। বিরাথু, যিনি উগ্রবাদের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন, সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন যেন, মিয়ানমারের বৌদ্ধ মেয়েরা অন্য কোনো ধর্মে বিশ্বাসীকে বিয়ে করতে না পারে সে মর্মে আইন করা হয়। তার নেতৃত্বে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আন্দোলন করেন। ফলে ২০১৫ সালে সরকার আইন পাস করে। এসব কিছু কাজে বিরাথু মিয়ানমারে জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং তার বার্তা অনেক ক্ষেত্রে জনগণের সমর্থন পায়। বিরাথু মনে করেন মিয়ানমারের আগামী দিন হবে ‘বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রাজ’। সু চি বিরাথুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ করেছেন। এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২০১৯ এপ্রিলে বিরাথু বলেন, ‘সু চি জানে কিভাবে চেহারায় মেকআপ মাখতে হয়, লিপস্টিক লাগাতে হয়। আর জানে কিভাবে ফ্যাশন পোশাক ও হাই হিল পরে হাঁটতে হয়।’

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি ইয়াংহি লিকে বিরাথু ‘একজন বেশ্যা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কোরিয়ান মহিলা ইয়াংহি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন। সু চি সরকারের মুসলিম উপদেষ্টা কো নি ইনকে যারা বিমানবন্দরে হত্যা করে তাদের বিরাথু ধন্যবাদ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। মিয়ানমারের অনেক সেনাকর্মকর্তাও বিরাথুকে অপছন্দ করেন। ধর্মমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রী অং কোর বিরুদ্ধে বিরাথুর অনেক অভিযোগ কেননা অং কো মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছেন বলে তার অভিযোগ। অপর দিকে অং কো বিরাথুকে ডাকেন, ‘উত্তেজিত পুংলিঙ্গ’ বলে। সু চির জন্য অশ্বিন বিরাথু একটি সঙ্কট। ধর্মের ভিত্তিতে বিরোধ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে বিরোধের কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে, দেশ ছাড়া হয়েছে। সু চির নৃতাত্ত্বিক বোঝাপড়ায় বিরাথু একটা বড় প্রতিবন্ধক।

গণতন্ত্রের জন্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও এক সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দেশের সৌন্দর্য। সেনাবাহিনীর চাপ ও প্রকৃত গণতন্ত্র- এ দু’টি বিষয়কে সামলানো সু চির দ্বিতীয় মেয়াদেও ফলপ্রসূ হবে কি না অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। সেনা ও উগ্রবাদকে যেভাবে তিনি বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে সমর্থন দিয়েছেন সেটি প্রশংসিত হয়নি। দেশের যে তিনটি বড় ইস্যু আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোর সমাধান করতে না পারলে সু চির পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর পাওয়া যাচ্ছে, সু চি তার কার্যক্রমকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করছেন। গত আগস্ট থেকে মিয়ানমারে কোভিড-১৯ মহামারীর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে ইয়াংগুনে লকডাউন শুরু হয়েছে। বিরোধীরা নির্বাচন স্থগিত করতে বলেছিলেন। নির্বাচন কমিশন তাতে রাজি হয়নি। সু চি বলেছেন, ‘নির্বাচন কোভিডের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ কিছু সমস্যা থেকেই গেছে, মিয়ানমারে এবার নির্বাচনী যুদ্ধক্ষেত্র, মানে ইন্টারনেট।

সু চি এ বছর ৭৫ বছরে পড়ছেন। তারপর কে গণতন্ত্রের হাল ধরবেন, তার জবাব নেই। এটিই এখন মিয়ানমারের বড় অর্থনৈতিক ঝুঁকি। এনএলডি মুখপাত্র মনিবা অং শিন বলেছেন, ‘দ্বিতীয় মেয়াদে হয়তো সু চি একটি পরামর্শক বোর্ডের কাছে ক্ষমতা দিয়ে সরে যেতে পারেন।’

মুখপাত্র মনে করেন, সেনাশক্তি ও মিয়ানমার রাজনীতির মধ্যে গোলযোগ নিশ্চিত। টোকিওর বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের প্রফেসর কেই নিমোটোও মনে করেন যদি সু চি এনএলডি ছেড়ে দেন তাহলে তার দল ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে। এখন রাজনৈতিক সরকার যে দিকনির্দেশনা দেবেন ও দেশের জন্য যে কাজ করবেন আগামী ৫০ বছর তার রেশ থেকে যাবে বলে মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞরা বলছেন। নির্বাচনে বিজয় পেয়ে এনএলডি ৪৮টি নৃতাত্ত্বিক দলকে ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেল ইউনিয়ন করার আহ্বান জানায়। মাত্র ১১টি দল আলোচনায় বসতে চায়। অনেক দল বলেছে, পত্রে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। জানুয়ারি ২০২১ সালে বৈঠকে বসার আগে এ বিষয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনীর রাজনীতি করা নিয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। Anand Panyarachun যিনি সরকার পরিচালনা করছেন এবং ১৯৯০ সালের সমস্যা থেকে দেশকে উত্তরণ করেছিলেন, বলেন, জনগণের বিক্ষোভ ও সেনাদের রাজনীতি করা কোনো ধর্মীয় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষয় নয়। জনগণের বিক্ষোভের বিষয়টি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সহজে নিষ্পন্ন করা যায়। এটি রাজনৈতিক মতাদর্শ; যুদ্ধের বিষয় নয়। মিয়ানমারেও সেনাবাহিনী এবং জনরোষ দূরীকরণে এই কৌশল কাজে লাগাতে চায়।

আগামী মার্চে সু চি দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার গঠন করবেন। বলা হয়েছে, তিনি সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে চান এবং সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করতে চান। সেনাবাহিনী চায় না এসব সশস্ত্র দলের সাথে সরকার আলাপ চালিয়ে যাক। এনএলডি এখন অর্থনৈতিক রিফর্মের কাজ করতে পারে যার কথা সু চি জনগণকে নির্বাচন আগ থেকে শুনিয়ে আসছেন। কিন্তু দেশ ও বিদেশের পুঁজি বিনিয়োগকারীরা সু চির কথার প্রতি অনুরক্ত নন; তারা বিগত কর্মকাণ্ডে নাখোশ হওয়ায় কোনো বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। মি. ভিকি বোম্যান, যিনি ২০০২-২০০৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং বর্তমানে মিয়ানমার সেন্টার ফর রেসপনসিবল বিজনেসের কর্মকর্তা, তিনিও এই মত পোষণ করেন। তিনি আরো বলেন, এনএলডি সরকার খুব ধীর গতির।

সমস্যার গতি ও সরকারের সিদ্বান্তের গতি সমান্তরাল নয়। সরকার অহেতুক সময় নষ্ট করে। সু চি ২০১৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিশ্বব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল যে, মিয়ানমারের জিডিপি ৮.২% অতিক্রম করবে কিন্তু সু চির আমলে ৭%ও অর্জিত হয়নি।

মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলেছে ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল। ১৯৪৮ সাল ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীনতার সময় আর্মি ক্ষমতা নেয়; গণতন্ত্র শুরু হয় ২০১১ সালে। সামরিক জান্তাকে ২০১০ সালে কাগজে-কলমে বিদায় করা হয় ও ‘জনগণের রাজ’ কায়েম হয়। তথাপি সেনাদের নির্দেশ সরকারকে মানতে হয়। মিয়ানমারের নৃতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় টেনশন বেশ উঁচুতে। তাই সে দেশে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় সব কিছু মিটিয়ে ফেলা ‘জাদুর খেলা’র মতোই মনে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design By Rana