মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০১:৩৫ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
হোয়াইক্যং ইউপির ঝিমংখালীতে তুচ্ছ ঘটনা কে কেন্দ্র করে হামলা: নারী সহ আহত-৫ খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন, ‘অল্প সময়ে সিদ্ধান্ত: বললেন আইনমন্ত্রী কঠিন সময় পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা আ.লীগের আছে: ওবায়দুল কাদের মার্কিন ভিসানীতি-নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না আ.লীগ: ওবায়দুল কাদের ভিসার বিধিনিষেধ আরোপের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য ‘অপমানজনক ও লজ্জাজনক: ফখরুল আমার ছেলে ওখানে আছে: সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে করবে, তাতে কিছু আসে যায় না: প্রধানমন্ত্রী পল্টনে ব্যাংকে ঢুকে ২০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২ পুলিশ কনস্টেবলসহ গ্রেপ্তার ৫ খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে আগের দুটি শর্তেই মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলো পদে পদে হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ: মঙ্গলবার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি
হিংসুকের হিংসাই নিজের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট

হিংসুকের হিংসাই নিজের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট

অন্যের ভালো দেখে সহ্য করতে না পারা, অন্যের ভালো দেখে নিজের মধ্যে কষ্ট অনুভব করা, অন্যের ভালো বিষয়টি ধ্বংসের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে দেওয়াকে হিংসা বলে। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তাঁর ফতোয়ার মধ্যে উল্লেখ করেছেন : হিংসা হচ্ছে অন্তরের এমন এক কষ্ট বা ব্যথা যা বিত্তশালীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেখার কারণে সৃষ্টি করে। কারও কারও মতে হিংসা হচ্ছে ‘অন্যের কাছ থেকে আল্লাহর নিয়ামত বিলুুপ্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ।’

হিংসার প্রকারভেদ : আল্লামা নববী (রহ.) মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হিংসা দুই প্রকার। ১. প্রকৃত হিংসা। অর্থাৎ যার সঙ্গে হিংসা করা হচ্ছে তার থেকে নিয়ামতটি দূর হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করা। ২. রূপকার্থক হিংসা। এটি প্রকৃত হিংসা নয়। অর্থাৎ যে নিয়ামতটি অন্যের কাছে আছে তা নিজের প্রাপ্তির প্রত্যাশা করা, অন্যেরটি বলবৎ থাকা অবস্থায়। এ প্রকার হিংসার আরেক নাম হলো ‘গিবতা’। এ গিবতা ইসলামে জায়েজ বা বৈধ।

মানুষ কেন হিংসা করে? আল্লামা গাজ্জালি (রহ.) হিংসার সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন : ১. শত্রুতা ২. নিজের ওপর অন্য কেউ সম্মানিত হয়ে যাওয়া ৩. অহংকার ৪. অস্বাভাবিকভাবে কেউ এগিয়ে যাওয়া ৫. নিজের পদ বা মর্যাদা হারিয়ে যাওয়ার ভয় করা ৬. নেতৃত্ব ও সম্মানের লোভ ৭. নিচু বা খারাপ মানসিকতা। (ফিকহি বিশ্বকোষ, কুয়েত)।
হিংসুকের আলামত : ১. অন্যের ভালো অবস্থার কারণে তাকে শত্রু ভাবা ২. তার প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া ৩. অন্যের কল্যাণের কারণে সব সময় অন্তরে এক ধরনের কষ্ট ও ব্যথা অনুুভব করা ৪. যার প্রতি হিংসা করে তার কাছ থেকে নিয়ামত চলে গেলে আনন্দিত হওয়া। যদিও এতে তার কোনো লাভ কিংবা ক্ষতি না থাকে ৫. সব সময় এ ব্যাপারে সতর্ক ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে যেন কোনোভাবেই চলে যাওয়া সে নিয়ামত আর ফেরত না আসে

হিংসুককে চেনার জন্য লোকমান হাকিম (রহ.) স্বীয় পুত্রদের বলেন, হে আমার সন্তানেরা! হিংসুকের লক্ষণ তিনটি। ১. এরা পেছনে গিবত করে ২. সামনাসামনি তোষামোদ করে ৩. বিপদে পড়লে তিরস্কার করে। (আত তাওবিখ, শায়েখ ইসবাহানি)।

হিংসুকের পরিণতি : রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা হিংসা ভালো অর্জনগুলো এমনভাবে নিঃশেষ করে দেয় যেভাবে আগুন কাঠ ধ্বংস করে দেয়। (ফয়জুল কাদির, আল্লামা মানায়ি।

ইসলামে হিংসা হারাম বা অবৈধ। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা পরস্পর হিংসা করবে না, শত্রুতা করবে না, অন্যের দোষ তালাশ করবে না এবং একজনের কেনাবেচা করার সময় অন্যজন দাম বাড়িয়ে দেবে না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই হয়ে যাও। (মুসলিম)। আল্লাহ হিংসুকের হিংসা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কোরআনের মধ্যে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে, হে আল্লাহ! আমি পানা চাই হিংসুকের হিংসা থেকে যখন সে হিংসা করে। (সুরা ফালাক, আয়াত ৫)।

তবে হাদিসে রসুল (সা.) দুটি বিষয়ে হিংসা করাকে জায়েজ বলেছেন। ১. আল্লাহ কাউকে কোরআনের ইলম দান করেছেন, সে দিনরাত তা তিলাওয়াত ও এর ওপর আমল করে। ২. আল্লাহ কাউকে সম্পদ দান করেছেন, সে দিবানিশি সেখান থেকে আল্লাহর পথে দান করতে থাকে। (বুখারি)। অর্থাৎ এ পুণ্যময় কাজ দুটি অন্যের মধ্যে দেখলে নিজে করতে না পেরে নিজের মধ্যে আফসোস সৃষ্টি এবং নিজেও এ দুটি গুণ অর্জনের চেষ্টা করা।

হিংসা আমল কবুলের এক শক্ত অন্তরায়

হিংসার পথ ধরেই আমাদের মনে আরেকটি রোগ জন্ম নেয়। একে আমরা বিদ্বেষ বলি। এমনিতেও শব্দ দুটি একে অন্যের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। হিংসা যেমন চুলার আগুনের মতোই আমাদের নেক আমলগুলো পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়, বিদ্বেষও তেমনি আড়াল হয়ে দাঁড়ায় আমাদের নেক আমলের সামনে। হাদিস শরীফে বিদ্বেষ পোষণকারীদের জন্যে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছে, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন উপস্থাপনায়। বিদ্বেষের ভয়াবহতা আমরা একটি হাদিস থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। হযরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : অর্ধ শাবানের রাতে (অর্থাৎ শবে বরাতে) আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সৃষ্টিকেই ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারীকে ক্ষমা করেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৯০)।

এই হাদিসে দুটি বিষয় লক্ষণীয় : এক. আল্লাহ তাআলা শবে বরাতে যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তাঁর সকল সৃষ্টিই যখন সেই ক্ষমা লাভে ধন্য হয়, তখনো বিদ্বেষপোষণকারী কেউ এ ক্ষমা পাবে না। দুই. বিদ্বেষপোষণকারীকে এ হাদিসে মুশরিকের সহযাত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মুশরিককে যেমন ওই রাতে ক্ষমা করা হয় না, তেমনি বিদ্বেষপোষণকারীকেও ক্ষমা করা হয় না। মুশরিক তো সে-ই, যে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শিরক করে। আর শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ।

শিরক করার পর তওবা না করে যে মারা যাবে তার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা খুবই স্পষ্ট- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সঙ্গে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না, এছাড়া অন্য কিছু যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যদি কেউ আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে তাহলে সে তো এক মহাপাপে জড়িয়ে পড়ল।’ (সূরা নিসা (৪) : ৪৮)।

এই হচ্ছে শিরক আর মুশরিকের পরিচয়। এ মুশরিকের সঙ্গে যখন কাউকে জুড়ে দেয়া হয় তখন তার হতভাগ্য আর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন থাকে না। একদিকে সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত, অপরদিকে মুশরিকের সহযাত্রী। বিদ্বেষকারীর গন্তব্য তাহলে কোথায়!

মুসনাদে আহমাদের রেওয়ায়েতে উপরোক্ত হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ তাআলা আপন সৃষ্টির দিকে সদয় দৃষ্টিতে তাকান। তখন তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। তবে দুইজনকে নয়, বিদ্বেষ পোষণকারী আর মানুষ হত্যাকারী।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৬৬৪২)।

এই হাদিসে বিদ্বেষপোষণকারীর সঙ্গী মানুষ হত্যাকারী। অন্যায়ভাবে কেউ যখন কাউকে হত্যা করে সেটা তো কুরআনের ভাষায় সকল মানুষকে হত্যার সমান অপরাধ! কুরআনের ভাষায় দেখুন, ‘আমি বনী ইসরাইলকে এ বিধান দিয়েছিলাম, যদি কেউ কাউকে হত্যা করে, প্রাণের বিনিময় কিংবা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর অপরাধে নয়, তাহলে সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল। (সূরা মায়িদা (৫) : ৩২)।

আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ‘প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার মানুষের আমল (আল্লাহ তাআলার সামনে) পেশ করা হয়। তখন আল্লাহ এমন সকল মানুষকে ক্ষমা করে দেন, যে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না।

তবে এমন দুজনকে তিনি ক্ষমা করেন না, যাদের অন্তরে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়-তাদের দুজনকে দেখো, তারা একে অন্যের সঙ্গে মিলে যায় কি না।’ (সহীহ মুসলিম : ২৫৬৫)।

এই তো বিদ্বেষ! এই বিদ্বেষ বান্দার আমল কবুল হওয়ার পথে এক শক্ত দেয়াল। প্রতি সপ্তাহে দুদিন যখন বান্দার যাবতীয় আমল আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়, আর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ঘোষিত হয় সাধারণ ক্ষমা, তখনো বিদ্বেষপোষণকারীরা বঞ্চিত। কথা হলো, বিদ্বেষ কী? খুব সহজ ভাষায় বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.।

তিনি বলেছেন, স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নিজের অন্তরে কারও প্রতি অশুভ কামনা পোষণ করা আর তাকে কষ্ট দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে বিদ্বেষ। অর্থাৎ কারও সম্পর্কে এমন কামনা করা-সে কষ্টে পড়–ক, তার ক্ষতি হোক, তার ব্যবসায় লোকসান হোক ইত্যাদি; এর সঙ্গে তাকে কষ্ট দেয়া এবং ক্ষতি করার তৎপরতা চালানো।

কারও দ্বারা নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্তে¡ও যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধনের চেষ্টা করে তার সাওয়াব আল্লাহর যিম্মায় রয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি জালেমদেরকে পছন্দ করেন না। যারা নিজেদের ওপর জুলুম হওয়ার পর (সমপরিমাণে) বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্যে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। আর প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে- এটা বড় হিম্মতের কাজ। (সূরা শূরা (৪২) : ৪০-৪৩)।

লেখক : মুহাদ্দিস, খতিব ও গবেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design By Rana