বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন
ভালোবাসা দিবসের যে ইতিহাস, তা জানলে কোনো মুসলিম সন্তান এ দিবস পালনে উৎসাহী হতে পারে না।
ভালোবাসা শুধু পবিত্র নয় পূণ্যময়ও বটে। নির্দোষ ও পরিশীলিত ভালোবাসা আমাদের ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ মসৃণ করে। সৃষ্টিজীবের প্রতি বিশেষ এবং পিতামাতা ও আল্লাহ-রাসূলের প্রতি সবিশেষ ভালোবাসা ছাড়া ঈমান পূর্ণতা লাভ করে না। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ.
‘ওই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন, তোমাদের কেউ সে পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তান থেকে বেশি প্রিয় হই।’ [বুখারী : ১৪]
অপর বর্ণনায় রয়েছে, আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ».
‘তোমাদের মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না আমি তার কাছে নিজ সন্তান, পিতা-মাতা ও সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র বলে বিবেচিত হই।’ [বুখারী : ১৫; মুসলিম : ১৭৮]
শুধু নিজেকে নয়; অন্যদেরও ভালোবাসতে বলা হয়েছে। প্রতিবেশিসহ সকল মুসলিম ভাইকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। একে অন্যকে ভালোবাসার এমন অবিনাশী চেতনা ইসলাম ছাড়া অন্য কোথাও নেই। ভালোবাসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, একে অপরের প্রতি ভালোবাসার প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,
﴿ مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ ﴾ [الفتح: ٢٩]
‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়।’ {সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ২৯}
অন্য ভাইকে ভালোবেসে তার সার্বিক কল্যাণ ও শুভ কামনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ – أَوْ قَالَ لِجَارِهِ – مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ».
‘তোমাদের মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে তার ভাই অথবা তিনি বলেছেন নিজের প্রতিবেশির জন্য তাই পছন্দ করে যা পছন্দ করে সে নিজের জন্য।’ [মুসলিম : ১৭৯]
একই সাহাবী থেকে বর্ণিত অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ».
‘তোমাদের মধ্যে কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করে যা পছন্দ করে সে নিজের জন্য।’ [বুখারী : ১৫; মুসলিম : ১৭৯]
ইসলাম শুধু অন্যকে ভালোবাসার কথাই বলেনি, নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যক্তি স্বার্থের উর্দ্বে থেকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«لاَ يَجِدُ أَحَدٌ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ حَتَّى يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَحَتَّى أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ وَحَتَّى يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا».
‘কোনো ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না সে পর্যন্ত যাবত না সে মানুষকে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে। আর যাবত সে এমন (ঈমানদার) আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে পরিত্রাণ দেবার পর সে কুফরে ফিরে যাবার চেয়ে তার কাছে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াই প্রিয়তর হয়। আর যাবত তার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁদের ছাড়া অন্যদের চেয়ে প্রিয় না হয়।’ [বুখারী : ৬০৪১]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَهُ فِى قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيدُ قَالَ أُرِيدُ أَخًا لِى فِى هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لاَ غَيْرَ أَنِّى أَحْبَبْتُهُ فِى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ فَإِنِّى رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ ».
‘এক ব্যক্তি তার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে অন্য জনপদে গেল। পথিমধ্যে আল্লাহ তা‘আলা তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা তার কাছে এসে বললেন, কোথায় চললে তুমি? বললেন, এ গ্রামে আমার এক ভাই আছে, তার সাক্ষাতে চলেছি। তিনি বললেন, তার ওপর কি তোমার এমন কোনো নেয়ামত আছে যার প্রতিপালন প্রয়োজন? তিনি বললেন, না। তবে এতটুকু যে আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তিনি বললেন, আমি তোমার কাছে আল্লাহর বার্তাবাহক হিসেবে এসেছি। আল্লাহ তোমাকে বার্তা জানিয়েছেন যে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন যেমন তুমি তাকে তাঁর জন্য ভালোবাসো।’[মুসলিম : ৬৭১৪]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا. أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ ».
‘যার হাতে আমার প্রাণ, তার কসম। তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যাবৎ না পরিপূর্ণ মুমিন হবে। আর তোমরা পূর্ণ মুমিন হবে না যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন জিনিসের কথা বলে দেব না, যা অবলম্বন করলে তোমাদের পরস্পর ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? (তা হলো) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।’[মুসলিম : ২০৩]
বিভীষিকার রোজ কিয়ামতে যখন সূর্য মাথার হাতখানেক ওপর থেকে অগ্নি বর্ষণ করতে থাকবে, প্রখন তাপে মাথার মগজ গলে পড়বে, তখন সাত শ্রেণীর লোক মহা প্রভাবশালী আল্লাহর আরশের সুশীতল ছায়াতলে স্থান পাবে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ওই দুই ব্যক্তি যারা শুধু আল্লাহর জন্যই একে অপরকে ভালোবাসে, তার জন্য মিলিত হয় আবার তাঁর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ فِي خَلاَءٍ فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسْجِدِ وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ إِلَى نَفْسِهَا قَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا صَنَعَتْ يَمِينُهُ.
‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন নিজের ছায়া দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ন শাসক, আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন যুবক, ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ আর তার চোখ অশ্রু ফেলে, ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের ভালোবাসায় ঝুলে থাকে, ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, যে ব্যক্তিকে রূপবতী কুলীন কোনো নারী নিজের প্রতি আহ্বান করে আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং যে ব্যক্তি এমন সংগোপনে সদাকা করে যে তার বাম হাত জানতে পারে না ডান হাত কী করেছে।’ [বুখারী : ৬৮০৬; মুসলিম : ২৪২৭]
বান্দা যতক্ষণ অপর ভাইয়ের সাহায্য করে আল্লাহ পাকও তাকে সে অবধি সাহায্য করেন। ভালোবাসার অকৃত্রিম প্রেরণায় একে অপরকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নায় সৃষ্টজীব বিশেষত মানবসেবার প্রতি গুরুত্বারোপ করে অসংখ্য বাণী বিবৃত হয়েছে। যেমন
« مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللَّهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ ».
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে। আর যে কেউ ইলম অর্জনের কোন পথ দেখাবে, আল্লাহ তাকে এর কারণে জান্নাতের দিকে একটি পথ সুগম করে দিবেন, কিছু লোক যখন আল্লাহর কোন ঘরে বসে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং তা নিয়ে পরস্পর পাঠ করে তখনই সেখানে প্রশান্তি নাযিল করা হয়, রহমত তাদের ঢেকে যায়, আর ফেরেশতা তাদের ঘিরে থাকে এবং আল্লাহ তাঁর কাছে যারা আছে তাদের কাছে এদেরকে স্মরণ করেন, আর যার আমল তাকে ধীর করেছে তাকে তার বংশ দ্রুত করবে না।” [বুখারী : ৭০২৮]
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا ، أَوْ مَظْلُومًا قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ هَذَا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا فَكَيْفَ نَنْصُرُهُ ظَالِمًا قَالَ تَأْخُذُ فَوْقَ يَدَيْهِ.
‘তুমি তোমার মুসলিম ভাইকে সাহায্য করো, চাই সে অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত। তখন তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অত্যাচারিতকে সাহায্য করার অর্থ তো বুঝে আসল, তবে অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরবে (তাকে জুলুম থেকে বাধা প্রদান করবে)।’ [বুখারী : ২৪৪৪]
অর্থাৎ তুমি তোমার ভাইকে সর্বাবস্থায় সাহায্য করবে। যদি সে জালেম হয় তাহলে জুলুম থেকে তার হাত টেনে ধরবে এবং তাকে বাধা দেবে। আর যদি সে মজলুম হয় তাহলে সম্ভব হলে তাকে সাহায্য করবে। যদিও একটি বাক্য দ্বারা হয়। যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে অন্তর দিয়ে। আর এটি সবচে দুর্বল ঈমান।
অপরের প্রতি দয়া ও সহযোগিতার হাত সেই বাড়িয়ে দিতে পারে সতত যার মন ভালোবাসায় টইটুম্বুর থাকে। অতএব ভালোবাসা কোনো পঙ্কিল শব্দ নয়, নয় কোনো নর্দমা থেকে উঠে আসা বা বস্তাপঁচা বর্ণগুচ্ছ। ভালোবাসা এক পুণ্যময় ইবাদতের নাম। ভালোবাসতে হবে প্রত্যেক সৃষ্টজীবকে, প্রতিটি মুহূর্তে। এর জন্য কোনো দিন নির্ধারণ করা, বিশেষ উপায় উদ্ভাবন করা মানব জাতির চিরশত্রু ইবলিসের দোসর ছাড়া অন্য কারও কাজ হতে পারে না।
কয়েক বছর পূর্বে এদেশে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’-এর আমদানি করে একটি প্রগতিশীল (?) সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। প্রতিযোগিতার বাজারে কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না বলে পরের বছর থেকেই অন্যান্য পত্রিকাও এ দিবসের প্রচারণায় নামে। এ দিবসটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়গুলোতে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে রাজধানী ঢাকায় একটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২০ হাজার টাকায়! কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও পার্কে তরুণ-তরুণীরা সোল্লাসে পালন করে এ দিবস। মূলত কার্ড ও বিভিন্ন উপহারসামগ্রী বিত্রেতারাই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এ দিবসের প্রচারণায় ইন্ধন যোগায়। এদিন যুবক-যুবতীরা যা করে তা শুধু ইসলামের দৃষ্টিতেই নয়, তথাকথিত আবহমানকালের বাঙালী সংস্কৃতির আলোকেও সমর্থনযোগ্য নয়।
ভালোবাসার জন্য কোনো বিশেষ দিবসের প্রয়োজন হয় না। বিশেষ পাত্র বা পাত্রিরও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বেলেল্লাপনা, বেহায়াপনা করার জন্য বিশষ সময়, দিবস লাগে, বিশেষ পাত্র বা পাত্রীর দরকার পড়ে। তাই ভালোবাসার কোনো দিবস পালন করা একটি ভাওতাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। হ্যাঁ, বেহায়াপনার জন্য দিবস হতে পারে। কারণ অশ্লীলতা চর্চাকারীরা তাদের নির্লজ্জ আচরণ সবসময় করতে পারে না, সবার সাথে করতে পারে না। এর জন্য উপলক্ষ দরকার। যে দিবসের আড়ালে বেলেল্লাপনা চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবাসা দিবস পালনের ধরন ও প্রকৃতিই আমাদের বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা প্রমাণে যথেষ্ট বলে মনে করি।
তাই আমরা এই দিবসের নাম রাখতে চাই ‘বিশ্ব বেহায়া দিবস’। এখন থেকে কুইজ প্রতিযোগিতার প্রশ্ন হবে বিশ্ব বেহায়া দিবস কবে? সঠিক উত্তর হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। এভাবে এ দিবসের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের যে ইতিহাস, তা জানলে কোনো মুসলিম সন্তান এ দিবস পালনে উৎসাহী হতে পারে না। তাই আসুন আমরা সংক্ষিপ্তভাবে এ দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য জেনে নেই।
ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের আগে চতুর্থ শতকে পৌত্তলিক, মূর্তিপূজারীদের সমাজে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেবতার অর্চনা করতে। পশু পাখির জন্য একজন দেবতা দেবতা কল্পনা করত। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য একজন দেবতার বিশ্বাস করত। যে দেবতার নাম ছিল ‘লুপারকালিয়া’। এই দেবতার সন্তুষ্টির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুবতীদের নামে লটারি ইস্যু করা। যে যুবতীর নাম যে যুবকের ভাগে পড়ত সে তার সাথে অগামী বছরের এ দিন পর্যন্ত বসবাস করত। এ দিন এলে দেবতার উদ্দ্যেশ্যে পশু জবাই করা হতো। জবাইকৃত পশুর চামড়া যুবতীর গায়ে পরিয়ে পশুটির রক্ত ও কুকুরের রক্তে রঞ্জিত চাবুক দিয়ে ছেলে-মেয়েকে আঘাত করত। তারা ভাবত এর দ্বারা নারী সন্তান জন্ম দেয়ার উপযুক্ত শাস্তি হয়। এ অনুষ্ঠানটি পালন করা হতো ১৪ ফেব্রুয়ারি।
খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হলে তারা এটাকে পৌত্তলিক কুসংস্কার বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু এতে দিবসটি পালন বন্ধ হয় না। পাদ্রীরা অপারগ হয়ে এ দিবসকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, আগে এ অনুষ্ঠান হতো দেবতার নামে, এখন থেকে হবে পাদ্রীর নামে। যুবকরা ১ বছর পাদ্রীর সোহবতে থেকে আত্মশুদ্ধি করবে। এদিনে সেই সোহবত শুরু ও শেষ হবে। ৪৭৬ সনে পোপ জোলিয়াস এ দিবসের নাম পরিবর্তনের পরে এ দিবসের নাম যাজক ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ রাখা হয়। ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে এ দিবসের নাম রাখার কারণ হলো এই খৃষ্টান যাজক কারাগারে বন্দি হওয়ার পর প্রধান কারারক্ষীদের মেয়ের সাথে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে প্রেমিকার উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে যান। এই জন্য খৃষ্টান সমাজে ‘প্রেমিকদের যাজক’ হিসেবে তার খ্যাতি লাভ হয়। এরপর থেকে তার মৃত্যু তারিখ তথা ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে পালিত হতে শুরু করে।
আমাদের যুব সমাজকে এসব ইতিহাস জানতে হবে। খুতবা, বক্তৃতা ও সকল গণমাধ্যমে এ দিবসের জন্মপ্রথা ও তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে। বুঝাতে হবে পৌত্তলিকদের উদ্ভাবিত, খৃষ্টানদের সংস্কারকৃত কোনো অনুষ্ঠান মুসলিমরা উদযাপন করতে পারে না। যুবসমাজ হলো জাতির প্রাণ। দেশের ভবিষ্যৎ। যুবসমাজের নৈতিকতার পতন হওয়া মানে ওই জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়া। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা উস্কে দিয়ে শত্রুরা আমাদের ভবিষ্যতকে গলা টিপে হত্যা করতে চায়। যুবকদের নৈতিকতার বলকে বিচূর্ণ করে আমাদের দুর্বল করে দিতে চায়। যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, তারা এ দিবসকে সমর্থন করে দেশ ও জাতির সর্বনাশ করতে পারেন না। যারা প্রগতিশীল, সুশীল ইত্যাদি বিশেষণে নিজেদের বিশেষিত করেন, তাদের প্রতি অনূরোধ-দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় তরুণ-তরুণীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অশ্লীলতার পথ থেকে ফেরান। তাদের নৈতিক পতন রোধ করুন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও উৎসবের নামে নীতি-নৈতিকতা ধ্বংসের প্রতিযোগিতা থেকে তাদের রক্ষা করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
লেখক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
Leave a Reply