শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৩ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
টেকনাফে কাগজে-কলমে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো এনজিও একলাব!

টেকনাফে কাগজে-কলমে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো এনজিও একলাব!

একলাব এর বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দূর্নীতি এবং সরকারী টাকা হরিলুটের অভিযোগ
মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, টেকনাফ থেকে ফিরে:
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-এলায়েন্স ফর কো-অপারেশন এন্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ (একলাব) এর বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দূর্নীতি এবং সরকারী টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) বাস্তবায়নে টেকনাফ উপজেলার ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড়ে এ প্রতিবেদক সরেজমিনে অনুসন্ধান করে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও এনজিও একলাব কর্তৃক সরকারী প্রকল্পের টাকা হরিলুটের চিত্র উঠে এসেছে। টেকনাফে কাগজে-কলমে প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এনজিও একলাব। কক্সবাজার জেলার উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ, মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের তদারকীর অভাবে এনজিও একলাব টেকনাফ উপজেলায় অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ উক্ত প্রকল্পকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  এরপরেও এ নিয়ে কোন ধরনের মাথা ব্যথা নেই খোদ সংশ্লিষ্ট উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্তৃক মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) বাস্তবায়নের জন্য সরকার ১৫ থেকে ৪৫ বয়সী নিরক্ষরদের মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ২য় পর্যায়ে শতাধিক উপজেলায় ৬ মাস মেয়াদী প্রকল্পটি গ্রহণ করে। প্রকল্পটি ২০২১ ইংরেজীর ৮ ডিসেম্বর টেকনাফ উপজেলায় শুরু হয়ে চলতি ২০২২ ইংরেজীর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সমাপ্ত হয়। সেই লক্ষ্যে এনজিও একলাব টেকনাফ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর এনজিও একলাব টেকনাফ উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড়ে ৩০০ শিখন কেন্দ্র কাগজে-কলমে স্থাপন করে। এনজিও একলাব ৬০০ শিক্ষক ও ১৫ সুপারভাইজার নিয়োগ করে। শিক্ষকদের মাসিক সম্মানি ২হাজার ৪’শ টাকা। আর সুপারভাইজারদের মাসিক সম্মানি ২ হাজার ৫’শ টাকা। ৩০০ শিখন কেন্দ্রের মধ্যে ১৫০টি শিখন কেন্দ্র ভাড়া নেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হয় কাগজে-কলমে। আর এসব শিখন কেন্দ্রের ভাড়া প্রতিটি ৫’শ টাকা। প্রতিটি কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ব্যয় মাসিক ১৫০টাকা। প্রতিটি শিখন কেন্দ্রের মাসিক জ্বালানী খরচ দেখানো হয় ৫’শ টাকা। গত মাসের জুনে ৬ মাস মেয়াদী ওই প্রকল্প শেষ হয়েছে। কিন্তু এনজিও একলাব টেকনাফের ৩০০ কেন্দ্রের ৬০০ শিক্ষককে মাসিক সম্মানি প্রদান করেছে মাত্র দুই মাসের। গত মার্চ মাসে শিক্ষকদের জনপ্রতি ৪ হাজার ৮’শ টাকা করে বিতরণ করা হয়। সেখান থেকে আবার বিভিন্ন ইউনিয়নের সুপারভাইজারেরা শিক্ষকদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ভাগ-বাটোয়োরা করে নিয়েছে।
জানা যায়, এনজিও একলাব ইতিমধ্যেই মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের ঢাকার প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে টেকনাফে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে বিভিন্ন ভূঁয়া বিল ভাউচার দাখিল করে সমুদয় বরাদ্দও উত্তোলন করে নিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে একাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে এনজিও একলাবকে উক্ত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে একাউন্ট পে চেক এনজিও একলাবের নামীয় ঢাকার আসাদ এভিনিউস্থ পুবালী ব্যাংক লিমিটেডের ২৭০৬১০২০০০০৯৫৭ নম্বর হিসাবে জমা করে বরাদ্দের টাকা ক্যাশও করে নিয়েছে। এনজিও একলাব দুই কিস্তিতে বরাদ্দের চেক পেয়েছে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে। প্রথম চেক পান চলতি বছরের মার্চ মাসে। ১ম বার বরাদ্দে এনজিও একলাব ৬০০ শিক্ষকের জন্য জনপ্রতি মাসিক সম্মানি ২হাজার ৪’শ টাকা করে তিন মাসের সর্বমোট ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১৫ জন সুপারভাইজারের মাসিক সম্মানি ২হাজার ৫’শ করে তিন মাসের ১লাখ ১২ হাজার ৫’শ টাকা, ১৫০টি শিখন কেন্দ্রের প্রতিটি ভাড়া বাবদ ৫’শ টাকা করে তিন মাসের ২লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০ শিখন কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ প্রতিটি ১৫০ টাকা করে তিন মাসের ১লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ৩০০ শিখন কেন্দ্রের প্রতিটির জ্বালানী খরচের বিল বাবদ প্রতিটি কেন্দ্র ৫’শ টাকা তিন মাসের ৪লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নেন।  এরপর একইভাবে চলতি মাসের শুরুর দিকে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসের বিলও উত্তোলন করে নিয়েছেন এনজিও একলাব।
টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের একাধিক শিখন কেন্দ্রের শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ৬মাস মেয়াদী প্রকল্প শেষ হয়। কিন্তু ৩০০ শিখন কেন্দ্রের শিক্ষকদের এনজিও একলাব সম্মানি প্রদান করেছে মাত্র দুই মাসের।  ১৫০টি কেন্দ্র ভাড়া হিসেবে দেখানো হলেও কোন কেন্দ্রের মালিককে কোন ভাড়ার টাকাও প্রদান করেনি এনজিও একলাব। এছাড়াও জ্বালানী বাবদ প্রতিটি কেন্দ্রে মাসিক ৫’শ টাকা করে সরকারীভাবে বরাদ্দ থাকলেও এনজিও একলাব কোন শিখন কেন্দ্রে জ্বালানী বিলের টাকা প্রদান করেনি। প্রতিটি শিখন কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা বিল বাবদ মাসিক ১৫০ টাকা করে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোন কেন্দ্রেই ব্যবস্থাপনা বিল দেওয়া হয়নি।  এছাড়াও টেকনাফের ৩০০ শিখন কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের মাঝে নিম্নমানের শিক্ষা উপকরণও বিতরণ করা হয়েছে। নিম্নমানের অনুশীলন খাতা, বলপেন কলম, চক, ডাস্টার, ব্লাকবোর্ড, সাইনবোর্ড, নিম্নমানের মাদুর দেওয়া হয়েছিল। এসব শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করার জন্য মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা হলেও নিম্নমানের উপকরণ ক্রয় করে টেকনাফের ৩০০ শিখন কেন্দ্রে বিতরণ করে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা লুটে নিয়েছে এনজিও একলাব।
এভাবে টেকনাপে মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের সরকারী ফান্ডের লাখ লাখ টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই প্রকল্পের অসাধু এনজিও কর্মকর্তা, প্রোগ্রাম কর্মকর্তা, উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক, সুপারভাইজাররা মিলেমিশে হরিলুট করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে বেতন ও অন্যান্য ভাতা বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এনজিও একলাবের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ তারিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, টেকনাফে ৩০০ শিখন কেন্দ্রের ৬০০ শিক্ষকের মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে শিক্ষক,সুপারভাইজারদের সম্মানির টাকা, ঘর ভাড়া ও জ্বালানীর টাকা উত্তোলন করেও কেন বিতরণ করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। এবং এ প্রতিবেদককে বলেন তিনিও সাংবাদিক। একই পেশার মানুষ। তার নামে তথ্য অধিদপ্তর থেকে সাংবাদিকতার বিশেষ কার্ডও রয়েছে। তিনি অসুস্থ্য তাই এ নিয়ে আর কথা বলতে রাজি হননি।
টেকনাফে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পে এনজিও একলাব কর্তৃক ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপানুষ্টানিক শিক্ষা ব্যুরোর কক্সবাজার জেলার সহকারী পরিচালক মো: আবদুল হামিদ জানান, শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ না করে পার পাবেনা এনজিও একলাব। তিনি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এদিকে টেকনাফের সচেতন সমাজ মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্প কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে এনজিও একলাব কর্তৃক লাখ লাখ টাকা হরিলুটের ঘটনায় তদন্তপূর্বক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দূর্নীতি দমন কমিশনের কাছে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design By Rana