শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
টেকনাফে ট্রিপল মার্ডারের নেপথ্যে : পাত্রী দেখা’ ছিল ফাঁদ, আড়ালে অন্য কাহিনি!

টেকনাফে ট্রিপল মার্ডারের নেপথ্যে : পাত্রী দেখা’ ছিল ফাঁদ, আড়ালে অন্য কাহিনি!

লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ হত্যার মূল ভূমিকায় ছিল আমিনের।
কোহিনূরের ঘরের পাশ থেকে রুবেলের জুতা ও বেল্ট উদ্ধার করেছে পুলিশ।
আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসে, এ হত্যাকাণ্ডে অন্তত ২০ জন নানাভাবে জড়িত ছিল। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

সাহাদাত হোসেন পরশ : রুবেল, ইউসুফ আর ইমরান। তাদের যারপরনাই দোস্তি। প্রতারণা ও অপহরণে তারা ছিল পটু। নানা অপরাধে জড়িয়ে ২০২১ সালের ১৪ আগস্ট তিন বন্ধু গ্রেপ্তার হয় একসঙ্গে। জমির হোসেন রুবেলের ‘জেল-পার্টনার’ ছিল অন্য মামলার আসামি মোহাম্মদ আলম শফি। পরে কারাগারের ভেতরেই গড়ে ওঠে রুবেল-শফির সখ্য। কিছুদিন পর তিন বন্ধু জামিনে ছাড়া পেলেও শফি ছিল কারাবন্দি। রুবেলের কারামুক্তির সময় শফি তার স্ত্রীকে দেখে রাখতে বলে। এই সূত্রে রুবেলের সঙ্গে শফির স্ত্রীর তৈরি হয় ‘গভীর সম্পর্ক’। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিষয়টি জানতে পারে শফি। তখন থেকেই রুবেলকে ‘শায়েস্তা’ করার ফন্দি আঁটে সে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে ‘পাত্রী দেখা’র ফাঁদ পেতে তিন বন্ধুকে টেকনাফে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

তিনজনকে হত্যার পর খুনিরা আলামত লুকানোর চেষ্টা করে। একজনের লাশ পুড়িয়ে বানানো হয় কঙ্কাল। মাটিতে পুঁতে রাখা হয় একজনকে। আরেকজনকে খুনের পর পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলা হয় গহিন জঙ্গলে। তিনজনের মধ্যে একজনের স্পর্শকাতর অঙ্গও পোড়ানো হয়। লাশের সঙ্গে এমন ক্রোধ দেখে তদন্ত সংস্থার ধারণা ছিল– নিছক অপহরণ নয়, ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেই এমন নৃশংসতা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্তে নেমে এমনই অজানা রহস্য ভেদ করেছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন বন্ধুকে অপহরণ ছক সাজানোর মূল কুশীলব মোহাম্মদ আলম শফি। এরই মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তে উঠে আসে, ২৮ এপ্রিল অপহরণ ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকেই শফির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রুবেলের। পরিকল্পিতভাবে টেকনাফে যাওয়ার পরপরই তিন বন্ধুকে অপহরণ করে গহিন পাহাড়ে নেওয়া হয়। এরপর শফির সঙ্গে যোগ দেয় টেকনাফের তালিকাভুক্ত দুর্ধর্ষ ডাকাত আবদুল আমিন। সে পুলিশ হত্যা মামলারও আসামি।

একজনের লাশ পুড়িয়ে ফেলাসহ হত্যার মূল ভূমিকায় ছিল আমিন। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় রয়েছে একাধিক সংস্থা। তবে আমিন এরই মধ্যে মিয়ানমারে পালিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এদিকে, এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সৈয়দ করিম ওরফে সোনা মিয়া ওরফে সোনালী ডাকাত ও ইমরুল করিম ফইর নামের দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত ও আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসে, এ হত্যাকাণ্ডে অন্তত ২০ জন নানাভাবে জড়িত ছিল। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, অনেক দিন ধরেই মানবাধিকারকর্মীর আড়ালে রুবেল কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে নারীদের পতিতাবৃত্তিতে ব্যবহার করত। এই কাজে তাকে সহায়তা করত ইউসুফ ও ইমরান। টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালি ও রোহিঙ্গা নারীদের নানা প্রলোভনে হোটেলে পাঠানোর কাজটি করত তারা। বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে এই চক্র এ ধরনের অপরাধে জড়িত– এমন আলামত পাওয়া গেছে।

রুবেলের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী এলাকায়। তার বাবা মৃত মো. আলম আর মা লেবাছ খাতুন। তার বন্ধু ইউসুফের গ্রামের বাড়ি ঈদগাঁর জালালাবাদ সওদাগরপাড়ায়। কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকায় ইমরানের বাড়ি। ২৪ মে দুপুরে র‍্যাব ও পুলিশের দুটি দল অভিযান চালিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে। অপহরণের পর থেকে তাদের পরিবারের কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য, অপহরণের ১২ দিন পর ১০ মে তাদের হত্যা করা হয়।

শুরু থেকে তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, রুবেলের মোবাইল ফোনসেট শফির কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সেটটি কিছুদিন শফির ভাগ্নে আরাফাতও ব্যবহার করত। অপহরণের পর রুবেলের ফোনসেট কয়েকটি হাতবদল হয়েছে। এ ছাড়া যখন অপহরণকারী স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করছিল, তখন তাদের কিছু কথোপকথন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এসেছে। তাতে বলতে শোনা হয়, অপহরণকারীরা তিন বন্ধুর উদ্দেশে বলছিল–  আর মেয়ে ধরবি?

জানা গেছে, ২৮ এপ্রিল বিকেলে কক্সবাজার থেকে তিন বন্ধু টেকনাফে এসে বাহারছড়া ফরেস্ট অফিসের সামনে নামে। এরপর পাহাড়ি যে এলাকায় প্রথম শফি তাদের অভ্যর্থনা জানায়, সেটি আবদুল সালাম নামের একজনের বাড়ির পাশে। এ ঘটনায় সালামের মেয়ে কোহিনূর বেগমকে অপহরণকারীরা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে কিনা, তদন্ত চলছে। কোহিনূরের ঘরের পাশ থেকে রুবেলের জুতা ও বেল্ট উদ্ধার করেছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকনাফ দমদমিয়া এলাকার যে গহিন পাহাড় থেকে তিন বন্ধুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নেই। ডাকাত দলের লোকজন বারবার সিম বদলের কারণে তাদের শনাক্ত করতে দেরি হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, অপহরণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, সবাইকে ধরতে অভিযান চলছে। প্রাথমিকভাবে মনে করছি, শফি এই হত্যা ছকের প্রধান পরিকল্পনাকারী। তাকে অচিরেই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করা হবে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. আবদুল হালিম বলেন, ট্রিপল মার্ডারে জড়িত কেউ যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, এ ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি।

সংগৃহিত :

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design By Rana