রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৭ পূর্বাহ্ন

বেরিয়ে আসছে ১৩০ টাকা বেতনের অপারেটরের ৪৬০ কোটির মালিক হওয়ার রহস্য

বেরিয়ে আসছে ১৩০ টাকা বেতনের অপারেটরের ৪৬০ কোটির মালিক হওয়ার রহস্য

বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নুরুল ইসলামের ৪৬০ কোটি টাকা আয়ের উৎস!
আবদুররহমান,টেকনাফ::

প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টম কার্যালয়ের সাবেক কম্পিউটার অপারেটর নুরুল ইসলামের অবৈধ আয়ের উৎসগুলো। তথ্য মিলেছে, এই বন্দরের ১০টির বেশি খাত থেকে টাকা ঢুকতো শুল্ক স্টেশনের এই অপারেটরের ব্যাংক হিসাবে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন নুরুল ইসলাম। চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনের এই কম্পিউটার অপারেটর এখন ৪৬০ কোটির মালিক।

তবে বিশেষ করে মিয়ানমারে আমদানি ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে পণ্য মিস ডিক্লারেশন থেকে প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকা ইনকাম ছিল ইসলামের। কখনও সুবিধা দিয়ে আবার কখনও জিম্মি করে আদায় করতেন এই টাকা। কিন্তু এ টাকার ভাগ পৌঁছে যেত সবার কাছে। এ ছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে তার স্বর্ণ চোরাচালানের একটি বড় সিন্ডিকেটও রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দরের সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা ধরা পড়লে বের হয়ে আসবে আরও অনেক কিছুই। নতুন করে তার সিন্ডিকেটের স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িতদের কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমরা এখনও নুরুল ইসলামের সিন্ডিকেটটি নজরদারিতে রেখেছি। খতিয়ে দেখা হচ্ছে অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমগুলো।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নুরুল ইসলামের বন্দর সংশ্লিষ্ট অবৈধ আয়ের ১০টির বেশি খাত নিয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খাতগুলো থেকেই টাকাগুলো কবজা করেছেন তিনি। তবে পণ্য মিস ডিক্লারেশন থেকে প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকা আয় ছিল ইসলামের। একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংস্থা এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছেন।

ওই খাতগুলোর মধ্যে মিয়ানমারে বিভিন্ন কসমেটিকস, সুপারি, স্যান্ডেল, নুডুলস ও কফিকে মিস ডিক্লারেশন দেখিয়ে প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকা আয় ছিল সবচেয়ে বড় উৎস। এ ক্ষেত্রে মাঝিরা সহায়তা করতেন। আর রফতানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে ট্রলারপ্রতি ৩০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিতেন তিনি। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে নুরুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে এসব খাত থেকে টাকাগুলো লেনদেন করেন তার প্রধান সহযোগী আরেক ‘কম্পিউটার অপারেটর’ নামে পরিচিত আহমেদ রানা ওরফে। পাশাপাশি ফরমালিন টেস্ট ছয় হাজার টাকা, ডাক্তারির টেস্টে এক হাজার, মেটাল টেস্ট চালান এক হাজার হাতিয়ে নের অন্য কর্মকর্তারা।

পণ্য মিস ডিক্লারেশন বিষয়ে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ধরুন প্রতি কেজি একটি পণ্য ভ্যাট ১শ’ টাকা আসছে। সেটি তিনি ১০ টাকা দেখাতেন। এখান থেকে প্রতিদিন হাজারো টন পণ্য আমদানি-রফতানি হচ্ছে। সে-অনুসারে তার দৈনিক আয় ছিল ৪০ লাখের বেশি।’

এত কিছু পরও এখনও এসব অবৈধ খাতগুলোর ঘুষ পুরোপুরি বন্ধ হয়েনি উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা মিয়ানমার থেকে মালপত্র আমদানি-রফতানি করে যে টাকা আয় হতো তার তিন ভাগের দুই ভাগ নুরুল ইসলামের পকেটে চলে যেত। এ ভাগের টাকা কাস্টমস কর্মকর্তা ও কিছু রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও পৌঁছাতেন নূরুল। তা ছাড়া এখানে তার স্বজনসহ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন, যারা এসব অপকর্মের পাশাপাশি ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান করেন। ফলে এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোটি টাকা মালিক বনে যান। নুরুল ইসলামের এত সম্পদ কেউ কখনও কল্পনাও করেনি।

স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদ

রাজধানীর ঢাকা উদ্যান, আমিনবাজার, মোহাম্মদপুরে ছয়টি বাড়ি ও ১৩টি প্লট রয়েছে নুরুল ইসলামের। এ ছাড়াও সাভার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ভোলাসহ বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে ৩৭টি বাড়ি, খোলা জায়গা-প্লট ও বাগানবাড়ি রয়েছে নুরুল ইসলাম দম্পতির।

টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টম কার্যালয়ের মাসিক মাত্র চার হাজার টাকা বেতনের সাধারণ এক কর্মচারী ছিলেন নুরুল ইসলাম। সেখানেই স্থানীয় পুরান পল্লানপাড়ার বাসিন্দা মৃত আবুল আহমদের মেয়ে রাজিয়া ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এক পর্যায়ে রাজিয়াকে বিয়ে করেন তিনি। তারপর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নুরুলের সাধারণ গৃহিণী রাজিয়া মালিক হয়েছেন ৩০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের। ঢাকায় রাজিয়ার নামে রয়েছে একাধিক অট্টালিকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও জমি কিনেছেন তিনি। নুরুল-রাজিয়া দম্পতি কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও সম্পদ বিবরণীতে এর অধিকাংশই গোপন করেছেন। এদিকে রাজিয়ার বাবা টেকনাফে একসময় মাত্র ৪ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন।

সূত্রমতে, এ দম্পতির সম্পদ বিবরণীতে মাত্র পাঁচ কোটি ৯৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬০ টাকার হিসাব দেখানো হয়েছে। ৪৫৪ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তারা। তবে অবৈধ পথে আয় করা কোটি কোটি টাকার সম্পদকে ‘হালাল’ করতে এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।

জানতে চাইলে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। তবে সিআইডি সাবেক কম্পিউটার অপারেটর নুরুল ইসলামের এত সম্পদের বিষয়ে ছায়া তদন্ত করছে। কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design By Rana